টেলিগ্রাম গ্রুপে বিকৃত যৌনতার এক অন্ধকার জগৎ

কিছুদিন আগে প্রথম আলো অনলাইনে লিখেছিলাম হোয়টসআপের একটা চক্রের কথা। যেখানে ফাসিয়ে নেওয়া হয় নগদ অর্থ । চক্ষু লজ্জায় বলতে পারতেন না নীরবেই অপরাধীকে তার চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিয়ে দিতের। কিন্তু এবারের গল্পটা একটু ভিন্ন। কল করার অ্যাপ টেলিগ্রামের একটা অন্ধকার জগৎ। যে জগতে একাধিক মেয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে পরিচয় গোপন রেখে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন একাধিক পুরুষ ও নারী। টেলিগ্রামের নিবন্ধন ফি ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা। আর এখানেই শেষ না। নিবন্ধিত হওয়ার পর আপনাকে তাদের নির্যাতনের ভিডিও থেকে শুরু করে নানা ধরনের ভিডিওতে আপনাকে গুনতে হবে ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে পুলিশ বলছে এই চক্রের নাম বিডিএসএম। এই চক্রের দুজন সুইটি আক্তার জারা ও শিখা আক্তার গত ১ মে বুধবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে মধ্যে রাতে ভাটারা থানার পুলিশ গ্রেফতার করে।

টেলিগ্রাম চক্র

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এই সামাজিক যোগাযোগই একমাত্র মাধ্যম। এই মাধ্যম থেকেই যোগাযোগ হয়। পরে ইনবক্সে ফোন নম্বর দেওয়া হয়, টেলিগ্রামেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখান থেকেই এই চক্রটির সঙ্গে জড়িয়ে পরে অনেকে। টেলিগ্রামে ৫০০ টাকা দিয়ে প্রথমে নিবন্ধন করতে হবে। এরপর নানা রকম ভিডিওর জন্য ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত টাকা হাতিয়ে নেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিস্ট্রেস ফারজানা মিলির একটি পোস্ট ‘আমার প্রিমিয়াম টেলিগ্রাম গ্রুপে জয়েন হতে চাইলে ইনবক্স কর….। টেলিগ্রাম মেম্বারশিপ মাত্র ৫০০ টাকা। গ্রুপে তাদের জন্য থাকবে আমার সেশন ভিডিও, পালিশমেন্ট, ভয়েজ ডমিনেট এবং টেলিগ্রামে আমি তোমাদের সাথে কানেক্টেড থাকবো। তাই আর দেরি না করে আজকেই জয়েন হয়ে যা আমার টেলিগ্রাম গ্রুপে।। অনলাইন এবং রিয়েল সেশন নিতে ইনবক্স কর।’ এমন বার্তা ও ছবি দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা।

 

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মাদ মাজহারুল ইসালাম ছবি : লেখক

ভাটারা থানার অভিযান 

এই চক্রকে ধরার জন্য বেশকিছু দিন ধরেই ছদ্মবেশে ঘুরছিল পুলিশ। এর আগেও এই ধরনের অভিযোগ এসেছে। কিন্তু চক্রটি দুই তিন মাস পরপর জায়গা পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে ধরাছোয়ার বাইরে থাকতো চক্রটি। ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মাদ মাজহারুল ইসামের সঙ্গে গত ১ মে বুধবার কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মাজহারুল ইসলাম অভিযানের পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন । তিনি বলেন,‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি বসুন্ধরার জি ব্লকের একটা বাসায় দীর্ঘদিন ধরে কয়েকজন নারী বিকৃত যৌনাচার চালাচ্ছে এবং সেই ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। ভাটারা থানা অনেক আগে থেকেই এই চক্রকে গ্রেফতার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। এটার নাম বিডিএসএম। শিখা আর জারা নামের দুই নারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় নানা রকম যন্ত্র সরজাম। যেমন চাবুক, বুট জুতা, পরিধেয় বিশেষ পোশাকসহ হাই হিল। এই চক্রের আরও অনেক সদস্য আছে আমরা ধরার চেষ্টা করছি।’

অনলাইনের অন্ধকার জগৎ

এই অন্ধকার জগতে জরিয়ে পড়েছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চক্রটির সঙ্গে যোগাযোগও করছে অনেকে। এখানে জড়িয়ে অনেকে ব্লাকমেইলের শিকারও হচ্ছে। ফেমডম সেশনের নামে নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি প্রচারে কাজ করে চক্রটি। মোহাম্মাদ মাজহারুল বলেন, ‘পুরুষদের উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন ও বিকৃত যৌনাচারের ভিডিও প্রচার করা হয়। এই কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিরা টেলিগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। জড়িত নারীরা নিজেদের “মিসট্রেস” হিসেবে পরিচয় দেন এবং পুরুষেরা টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে নির্যাতিত হতে আগ্রহী হন, যা “ফেমডম সেশন” নামে পরিচিত। বাদী শিখা আক্তার নামে একজনের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন এবং তাদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৫০০ টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় যেতে বলা হয়। তিনি গত ৩০ এপ্রিল সেখানে যান। গিয়ে দেখতে পান শিখা আক্তার ও সুইটি আক্তারসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন একজন পুরুষকে উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন করছেন এবং মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছেন। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যান্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে এই সব ভিডিও ধারণ করে টেলিগ্রামে যেমন বিক্রি করছে, তেমনি আবার অনেককে ব্লাকমেইল করেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’

 সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নামে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা বিভিন্ন নামে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে থাকে। জারা আর শিখার স্যোসাল মিডিয়ার নাম মিসট্রেস ফারহানা মিলি ও মিসট্রেস জেরি। তারা এই ছদ্ম নামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ সাইটে প্রচার করে ‘সেশন নিতে হলে আমার টেলিগ্রাম অথবা আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মেসেজ দিয়ে বুকিং কনফার্ম করতে হবে।’ এই ধরনের পোস্ট দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অসংখ্য অ্যাকাউন্ট খোলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই কার্যক্রম চালাচ্ছেন এই চক্রটি।

টেলিগ্রাম স্লেভ গ্রুপ

টেলিগ্রামের এই গ্রুপে টেলিগ্রামে ভয়েস পানিশমেন্ট, ভিডিও পানিশমেন্ট রয়েছে। ছবি, ভিডিও পাওয়া যাবে। গ্রুপে থেকে চ্যাট করতে পারবে। যোগ্যতা হিসাবে স্লেভকে ১০০০ টাকা প্রতিমাসে দিতে হবে। এইগুলোর জন্য তাদের ইনবক্সে আবেদন করতে হয়।

এই চক্রের দুজন সুইটি আক্তার জারা ও শিখা আক্তার গত ১ মে বুধবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে মধ্যে রাতে ভাটারা থানার পুলিশ গ্রেফতার করে। ছবি : লেখক

আইনী প্রতিকার

বিকৃত যৌনাচার ও ভিডিও ধারণ করে তা টেলিগ্রামে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে কি কি শাস্তি হতে পারে সে ব্যপারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ফাইন্ড মাই এডভোকেটের প্রতিষ্ঠাতা মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান যদি কোন ব্যাক্তি যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন  ভিডিও চিত্র, স্থির চিত্র ধারণ করে  ও প্রচার করে-যার কোনো শৈল্পিক মূল্য নেই, তা পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে।

পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যাক্তির নগ্ন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি নিজের কাছে রাখেন বা তা কোন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মেসেন্জারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন তাহলে তিনি এই ধারা মোতাবেক শাস্তি পাবেন।

১. কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি তৈরি করিলে উক্ত ধারা অনুযায়ী উক্তরূপ অপরাধের জন্য অপরাধী সর্বোচ্চ ৭ (সাত) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লাখ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

২. কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদাহানি করলে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় করলে উক্ত অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লাখ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

৩. কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লাখ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

দুই নারীকে ইতি মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে পর্নোগ্রাফি মামলা দায়ের হয়েছে। ভিডিওতে একজন পুরুষকে চাবুক দিয়ে মারধর করতে দেখা যায়, তবে এটি মারাত্মক আঘাত, অমানবিক আচরণ এবং  মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হতে পারে। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে তদন্ত করে পুলিশ ভুক্তভোগীর চিকিৎসা রিপোর্ট সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় দন্ড বিধি অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে।

 

 

 

 

 

Scroll to Top